সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জাপানের আত্মহত্যার বন | ভয়ংকর সুন্দর - যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১০০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়





জাপানের আওকিগাহারা বন (Aokigahara) মৃত্যূর জন্য একেবারে নির্জনতম স্থান ।

জাপানের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট ফুজির পাদদেশে অবস্থিত এই বনটি পুরো এলাকার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা । কিন্তু, এই বনের গাছ-গাছালি এতই ঘন যে খুব সহজেই আপনি এখানে হারিয়ে যেতে পারবেন ।



প্রতি বছর এখানকার কর্তৃপক্ষ প্রায় ১০০টি মৃতদেহ উদ্ধার করে, আর বাকি মৃতদেহগুলো অনাবিষ্কৃত থেকে যায় বছরের পর বছর । ঠিক কি কারনে মানুষ আত্মহত্যার জন্য এই বন বেছে নেয় তা এখনো রহস্যের মতো । ধারনা করা হয় যে, কোন এক উপন্যাসের নায়ক প্রথম এই বনকে বেছে নেয় আত্মহত্যার জন্যে । উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই বন আত্মহত্যার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ।




প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটারের এই বনের প্রবেশমুখে আত্মহত্যাপ্রবন মানুষদের জন্যে একটি সতর্কবানী দেয়া আছে । এতে জাপানী ভাষায় লেখা আছে,

আপনার জীবন আপনার পিতা-মাতার দান করা অমুল্য উপহার । দয়া করে আপনার পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং সন্তানদের কথা ভাবুন । আপনার মনের কথা জমিয়ে রাখবেন না, সমস্যাগুলোর কথা আরেকজনের কাছে খুলে বলুন ।
এরপর এতে 'আত্মহত্যা-প্রতিরোধ সংস্থা'র ফোন নম্বর এবং যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া আছে ।


আজুসা হায়ানো (Azusa Hayano) নামের একজন ভূবিজ্ঞানী প্রায় ৩০ বছর ধরে এই বনে বসবাস, তদারকি এবং গবেষনার সাথে যুক্ত আছেন । তিনিও ঠিক ভেবে পাননা যে মানুষ কেন ঠিক এই বনকেই আত্মহত্যার জন্য বেছে নেয় ।

উনার এমনই দ্বায়িত্ব যে মাঝে মাঝে উনি নিজেই অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন, অনেক সময় হাটতে হাটতে পায়ের নিচে আবিষ্কার করেছেন একটু আগে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে এমন মৃতদেহ । এই ব্যক্তি নিজেই গত ২০ বছরে ১০০টির মতো মৃতদেহ আবিষ্কার করেছেন বলে তার ধারনা ।

এই মধ্যবয়ষ্ক ব্যক্তি, একদল সদস্য এবং ক্যামেরা ক্রুদের সাথে নিয়ে ভাইস ডট কম একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে । ভিডিওটিতে তারা স্থানীয় ভাষায় 'জুকাই' নামে পরিচিত ঐ বনের একেবারে গভীরের চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছেন ।

যদিও জনাব হায়ানো নির্দিষ্ট করে মানুষের আত্মহত্যার কারণ বলতে পারেন নি, তবুও তিনি ঐ ভিডিওতে আত্মহত্যাপ্রবন মানুষদের হতাশা, ক্ষোভ এবং ভিতরে ভিতরে জমে থাকা ফিরে না আসার প্রত্যয় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন ।

ভয়ঙ্কর এই ভিডিওতে তিনি দর্শকদের দেখিয়েছেন কিভাবে মানুষ মৃত্যূর আগে গাছের কোঠরে, শেকড়ে কিংবা আশেপাশের সর্বত্র তার হতাশা আর ক্ষোভের চিহ্ন রেখে যায় । আবার অনেক সময় অনেক চিহ্ন প্রকাশ করে যে, মানুষটি মরতে এসেও আবার বুক ভরা আশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ।

পরিসংখ্যান বলছে, এই বনে পাওয়া মৃতদেহের সংখ্যা একেক বছর একেক রকম । যেমন - ২০১০ সালে ১০৮ টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, যেখানে ২০০২ সালে পাওয়া যায় ৭৮টি মৃতদেহ । বেশ কয়েক বছর ধরে আত্মহত্যার পরিমান এতোই বেড়ে চলেছে যে, এখানকার কর্তৃপক্ষ পুলিশ টহল বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে । যদিও এতো বড় বনে টহল দিয়ে সবার আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় ।

সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা এবং লেখাগুলো বলছে, এই বনে এতো আত্মহত্যার জন্যে জাপানের অর্থনীতির নিম্নমূখী প্রবণতাই দায়ী, ঠিক যতটা না দায়ী সেইকো মাতসুমোতোর (Seicho Matsumoto) লেখা সেই বিখ্যাত উপন্যাস Kuroi Jukai


আধুনিক বিজ্ঞান যদিও 'অতৃপ্ত আত্মা' তত্ত্বে বিশ্বাস করে না, তবুও জাপানের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের বিশ্বাস যে এই বনের অস্বাভাবিক ভৌতিক পরিবেশে আতঙ্কিত এবং এতো গভীর বন থেকে পালাবার পথ খুঁজে না পাওয়া মানুষদের মৃতদেহই এখানে খুঁজে পাওয়া যায় ।

স্থানীয়দের মতে, খুব সহজেই এখানকার তিন ধরনের দর্শনার্থীদের পৃথক করতে পারা যায় । এক, যারা এখানকার 'মাউন্ট ফুজি' পর্বত এবং এর চারপাশের অবারিত সবুজের স্বাদ পেতে আসে । দুই, যারা এখানকার ভৌতিক পরিবেশকে উপভোগ করতে আসে । এবং তিন, যারা আসে আর কখনো না ফেরার আশায়, সবকিছু হারিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে ।

এই বনের কর্মীরা কোন মৃতদেহ দেখার পর তা উদ্ধার করে স্থানীয় থানায় তা পৌছে দেন । তারা সবসময় চেষ্টা করেন যাতে সকল মৃত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা যায় । কারণ তারা বিশ্বাস করেন, মৃত ব্যক্তির লাশ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকলে তার আত্মা পুরো বনে ঘুরে বেড়ায় । ছটপট করতে থাকা এসব আত্মার মুক্তির জন্যে তারা চেষ্টা করেন সকলের মৃতদেহ তাদের পরিবারের কাছে পৌছে দিতে ।

যদিও সকলের মৃতদেহ ঠিক সময়ে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না । কিছু কিছু মৃতদেহ পাওয়া যায় শকুন কিংবা শেয়াল-কুকুরে খুঁবলে খাওয়া ।

আবার কারো কারো মৃতদেহ পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়ার ১০- ১৫ বছর পরে । তখন অবশ্য ওখানে মৃতদেহ পাওয়া যায় না । হাড়-কঙ্কাল, কাপড়-চোপড়, সুইসাইড নোট বা মৃত্যুর আগে প্রিয় জনের জন্য রেখে যাওয়া উপহারগুলো দেখে লাশ সনাক্ত করা হয় ।


সবশেষে আবার ফিরে যাচ্ছি সেই জনাব হায়ানোর কাছে । যিনি গত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং সমসাময়িক ঘটনা থেকে বুঝতে পারেন যে, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল সাইটের বদৌলতে মানুষ যে দিন দিন নিসঙ্গ এবং একা হয়ে পড়ছে এটা তারই লক্ষন ।

পুরো ডকুমেন্টারির শেষে জনাব আজুসা হায়ানো একটি বার্তা সবার কাছে তুলে ধরেন,
"বর্তমানে আমরা আমাদের জীবনটা সারাদিন অনলাইনে থেকেই কাটিয়ে দিতে পারি । কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে আমাদের এখনো একজন আরেকজনের মুখোমুখি হতে হয়, তাদের অভিব্যক্তিগুলো পড়তে হয়, তাদের শব্দগুলো শুনতে হয় যাতে আমরা একে অপরের অনুভূতিগুলো ঠিকভাবে বুঝতে পারি - যাতে আমরা একসাথে বাঁচতে পারি ।"

সম্পুর্ণ ডকুমেন্টারিটি দেখুন এখানে -



তথ্যসূত্র -

  • উইকিপিডিয়া (https://en.wikipedia.org/wiki/Aokigahara)
  • ডেইলি মেইল (http://www.dailymail.co.uk/news/article-2127414/The-suicide-forest-Japan-Mystery-Mount-Fuji-beauty-spot-100-bodies-year.html)
  • ভাইস (http://www.vice.com/video/aokigahara-suicide-forest-v3)
  • http://www.atlasobscura.com/places/aokigahara-suicide-forest

মন্তব্যসমূহ