সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রোবট কি একদিন মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? – আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ব্ল্যাক-বক্স লার্নিং



আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ভালো বাংলা করলে দাঁড়ায়, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্তিমভাবে বানানো আপনার হাতের বুদ্ধিভিত্তিক স্মার্টফোনই বলেন কিংবা চালকবিহীন গাড়ির কথাই বলেন, অফিসিয়ালি আমরা বর্তমানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর যুগে বাস করছি। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় রোবটের কথা চিন্তা করলে আমাদের মাথায় সর্বপ্রথম আসে হলিউডে বানানো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার কথা, যেখানে রোবট একসময় মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু আসলে কি হতে যাচ্ছে? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি তাহলে রোবট দ্বারা পরিচালিত হবে? ইত্যাদি বিষয়াদিসহ এই লেখায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও এর ‘ব্ল্যাক-বক্স’ এবং এর সাথে সম্পর্কীত মূল ধারণা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া - যার মাধ্যমে একটি সিস্টেমকে আশেপাশের তথ্য সংগ্রহ করে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।


শুরুতেই জানিয়ে রাখি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণা নতুন কিছু নয়। সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটিং এর ধারণা দেয়া হয়েছিলো সেই ১৯৫০ সালে। তারপর থেকে গবেষকরা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, একটা মেশিনকে কিভাবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালানো যায়।

সেই ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ডেভেলাপার বা গবেষকদের কাজের মূল ধারার কোন পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন যা হওয়ার তা হয়েছে আদিম কম্পিউটিং শক্তিতে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের গবেষকরা যেখানে বিশালাকৃতির কম্পিউটার নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেখানে আজকে ছোট্ট কয়েনের সমান চিপ দিয়েই কাজ করছেন। এভাবে যেমন হার্ডওয়্যারের আকারে পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি পরিবর্তন হয়েছে রোবটের আকারও।

“একটি যন্ত্র যদি মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কাজ করতে পারে, তাহলে ঐ যন্ত্রটি মানুষের মতোই বুদ্ধিমান হতে পারে।“
_ অ্যালেন টুরিং(১৯১২-১৯৫০), কম্পিউটার বিজ্ঞানী, লন্ডন, ইংল্যান্ড।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স

সহজভাবে বললে, ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ হলো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি সিস্টেমকে আশেপাশের তথ্য সংগ্রহ করে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। একটি সাধারণ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর উদাহরণ হতে পারে, একটি কম্পিউটার যেটি একজন মানুষের ১ হাজার ছবিকে স্যাম্পল হিসেবে নেবে এবং ইন্টারনেটে এরকম হুবুহু চেহারার ছবিগুলোকে আলাদা করে বাছাই করতে পারবে।

বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফেসবুক একটি বড় অংশ জুড়ে বিরাজ করছে। এরই মধ্যে আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, ফেসবুকে আপনি যখন আপনার বন্ধুদের ছবি আপলোড করেন তখন ফেসবুক স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনাকে এবং আপনার বন্ধুদের চেহারা দেখে সনাক্ত করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সবাইকে নিজ উদ্যোগে ট্যাগ করে দেয়। এই প্রক্রিয়াও এক ধরণের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মূল উদ্দেশ্য স্বয়ংক্রিয় ভাবে মানুষের সাহায্য ছাড়া মেশিনকে কাজ করানো। একটি লেভেল চার এর স্বয়ংক্রিয় গাড়ি বলতে বুঝায় এমন গাড়িকে যার স্টিয়ারিং কিংবা গিয়ার পাল্টানোর জন্য কোন মানুষের প্রয়োজন হয় না। ভবিষ্যতে যদি এমন গাড়ি বানানো সম্ভব হয়ে যেটি চালানোর জন্য কোন মানুষ, জিপিএস, গ্রিড, সার্ভার বা অন্য কোন কিছুর সাহায্যের দরকার হবে না, তখন সেটি হবে লেভেল পাঁচ এর স্বয়ংক্রিয় গাড়ি।

সুতরাং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর নির্দিষ্ট কোন গন্ডি বা সীমারেখা নেই। একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স উন্নত করার মূল প্রক্রিয়া বা অংশগুলো হচ্ছে এলগরিদম, মেশিন লার্নিং, ব্ল্যাক-বক্স, নিউরাল নেটওয়ার্ক, ডিপ লার্নিং, স্বাভাবিক ভাষার প্রক্রিয়াকরণ, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং, সুপারভাইজড লার্নিং, আনসুপারভাইজড লার্নিং ইত্যাদি। এতসব কঠিন বিষয় এখানে বিশ্লেষন করলাম না, এগুলো নিয়ে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন এখানে

ব্ল্যাক-বক্স আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি?

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় যখন কোন সিস্টেমকে আগে থেকে কিছু নিয়ম কানুন শেখানো হয় এর পরের ধাপ হচ্ছে এই ব্ল্যাক-বক্স। সিস্টেমকে যখন প্রাথমিকভাবে বলে দেয়া হয় এটা করা যাবে না, এটা করতেই হবে বা এটা হলে পরে ঐটা করবে এরকম নিয়ম-কানুন জানার পরে সিস্টেমটি নিজে নিজে কিছু অংক কষে। এই অংক বা লজিকের খেলা গুলো হয়তো অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে না (কিংবা মানুষের অত সময় নেই এত জটিল কায়দা বুঝার জন্য) কিন্তু সিস্টেম ঠিকই এভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা আউটপুট বের করে নিয়ে আসে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর এই প্রক্রিয়া যেহেতু মানুষের অগোচরেই ঘটছে তাই একে বলা হয় ‘ব্ল্যাক-বক্স আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’।

‘ব্ল্যাক-বক্স’ বলতেই মনে হয় ‘রহস্যময় কিছু’। তাই বর্তমান সময়ে অনেক ‘পাবলিক খাওয়ানো’ আর্টিকেল বের হয়েছে যাতে হালকার উপর ঝাঁপসা ধারণা বা আন্দাজ দিয়েই বুঝানো হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সবচেয়ে ভয়ানক(!) অংশ হচ্ছে এই ব্ল্যাক-বক্স। অনেকসময় আমরা অনেক কাজ করার আগেই লম্বা সময় ধরে অনেক কিছু ভেবে নিই, কাউকে না জানিয়ে বা কোন কাজ না করেই অনেক হিসেব মিলাই। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ব্ল্যাক-বক্সও এর ব্যতিক্রম নয়।






আমেরিকার স্বয়ংক্রিয় ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম’ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে সনাক্ত করে ভবিষ্যতে ঐ ব্যক্তির কোন অপরাধে যুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে কিনা।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভয়!

আমেরিকার স্বয়ংক্রিয় ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম’ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে মানুষের ছবি দেখে সনাক্ত করে ভবিষ্যতে ঐ ব্যক্তির কোন অপরাধে যুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে কিনা। কিন্তু প্রো-রিপাবলিকার অ্যাওয়ার্ড জয়ী আর্টিকেলের মাধ্যমে দেখা যায়, কিভাবে এই সিস্টেম বর্ণ-বৈষম্য তৈরি করছে। ঐ আর্টিকেলে দেখানো হয় যে, কিভাবে ঐ সিস্টেম শুধুমাত্র কালো বর্নের হওয়ার কারণে অযথা নিরপরাধ ব্যাক্তিকে ‘উচু স্তরের ভয়ংকর’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। তাই এধরণের বিতর্কের অবসানের জন্য ‘এআই নাউ (AInow)’ সরকারি বা আদালতের কাজে এধরনের ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমের ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছে।

কিন্তু এর বিপরীত দিকও আছে! কিছু ব্ল্যাক-বক্স আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের চেয়েও দ্রুত গতিতে ও নির্ভুলভাবে মানব শরীর থেকে ক্যান্সার দূর করতে পারে। এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, যদিও এধরণের সিস্টেম কিভাবে ‘ব্ল্যাক-বক্স থিংকিং’ এর মাধ্যমে ক্যান্সারের জীবানু সনাক্ত ও নির্মুলের সিদ্ধান্তে এসেছে আপনি তা জানেন না। কিন্তু তাই বলে কি এ ধরনের ক্যান্সাররোধী আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার বন্ধ করে দিবেন?

এই ধরনের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ভিন্ন প্রটোকল ব্যবহার করা হয়। এখন যদি আপনি যদি একটি রোবট বানান যার কাজ হচ্ছে, জরুরী পরিস্থিতিতে পানি দিয়ে আগুন নিভানো। এবং ঐ রোবট যদি পানির সম্ভাব্য উৎস কি হতে পারে বা ‘জরুরী পরিস্থিতি’ বলতে আসলে কোন পরিস্থিতি তা না জানে তাহলে এটি অবশ্যই ভয়ানক রূপ নিতে পারে একসময়। হয়তো দেখা গেলো, ঐ রোবট চুলার প্রয়োজনীয় আগুনসহ সব আগুন নেভানো শুরু করে দিবে। এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা চিত্র, যেটা দিয়ে আমি বুঝানোর চেষ্টা করছি যে অধিকতর জ্ঞান অর্জন বা পক্ষপাত্মূলক আচরণ নির্মুল ছাড়া একটি রোবট কখনোই নির্ভুল ও স্বয়ংক্রিয় কাজ চালিয়ে যেতে পারে না। তাই এধরণের মাইলফলকগুলো অর্জন করা ছাড়া আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার করা নিতান্তই বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমাদের বর্তমান রিসার্চার বা ডেভেলাপাররা এব্যাপারে যথেষ্ট সচেষ্ট এবং সক্রিয়। এসব ব্যাপারগুলো মাথায় রেখেই তারা একের পর এক অনন্য আবিষ্কার আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। একেকটি আবিষ্কারের পর তা নিয়ে আবার ব্যাপক লেখালেখি-গবেষণা হচ্ছে। তাই একটা সিস্টেম ডেভেলাপ করা পর্যন্ত এনিয়ে অনেক চুলচেরা বিশ্লেষন সিস্টেমটিকে মানুষের জন্য ভয়ংকর করে তুলবে না তা আশা করাই যায়। এরপর যেটা বাকি থাকে সেটা হচ্ছে ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমের ভেতরের ‘ব্ল্যাক-বক্স লার্নিং’, যা মানুষের অগোচরে ঘটছে। তবে একটা ব্যাপার বলা যায় যে, সায়েন্স ফিকশনের সেই যুগে হয়তো আমরা কখনোই যাবো না, যেখানে বিশাল ক্ষমতাধর রোবট মানুষকে একে একে পিষে মারবে, কারন এর ব্ল্যাক-বক্স-ডিপ-লার্নিং।

আগেই বলেছি একটি সিস্টেম বানানোর পর, তার চিন্তা করার ক্ষমতার জন্ম হয় কিছু নিয়ম কানুন আগে থেকে জানানোর পর। এখন এসব এলগরিদম বা নিয়ম-কানুন যদি মানব-কল্যানের স্বার্থে রোবটের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়, তাহলে সে মানব-কল্যানেই কাজ করবে। কিন্তু যদি ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য এসব রোবটের এলগরিদম তৈরি করা হয়, তাহলে সেটি অবশ্যই ধ্বংসাত্মক কাজই করবে। সবগুলো আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রক্রিয়ার গোঁড়ায় মানুষের হাত আছে, তাই মানুষের হাতেই সবকিছু।

তাই অন্যান্য সব আবিষ্কারের মতো এক্ষেত্রেও প্রশ্নটি চলে আসে, আমাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো ভয়ানক? নাকি আমরাই এগুলোকে ভয়ংকর বা মারনঘাতী হিসেবে ব্যবহার করছি? সবশেষে স্পাইডারম্যান সিনেমায় পিটার পার্কারের বলা আমার সবচেয়ে প্রিয় উক্তিটি তুলে ধরছি,
“With Great power, comes great responsibility (বিশাল ক্ষমতার সাথে সাথে বিশাল দ্বায়িত্বও চলে আসে)”

(পূর্বে আমার ব্যক্তিগত সাইটে প্রকাশিত এবং ঈষৎ সম্পাদিত) 

তথ্য কৃতজ্ঞতা -
  • https://en.wikipedia.org/wiki/Artificial_intelligence, Artificial intelligence - Wikipedia, October 2017.
  • https://futureoflife.org/background/benefits-risks-of-artificial-intelligence/, Benefits & Risks of Artificial Intelligence - Future of Life Institute, October 2017.
  • http://www.businessinsider.com/researchers-predictions-future-artificial-intelligence-2015-10, 18 researchers predict the future of AI - Business Insider, October 2017.
  • http://fortune.com/2018/02/21/artificial-intelligence-oxford-cambridge-report/, Artificial Intelligence: Here's the Biggest Risks | Fortune, October 2017.
  • https://www.sentient.ai/blog/understanding-black-box-artificial-intelligence/, How transparent is your AI? And are 'black box' systems better? - CIO, February 2018.
  • https://genius.com/Stephen-hawking-on-the-threat-of-artificial-intelligence-annotated, Stephen Hawking – On the Threat of Artificial Intelligence | Genius, October 2017.

মন্তব্যসমূহ